golpo-ghar.blogspot.com |
জাহিদ হা করে কতোক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার কাজে মন দেয়। দুইদিন পর আবার দেখে,'আস সালামু আলাইকুম।' জাহিদ আবার হা করে তাকায়। যে মেয়েগুলি মেসেজে 'হাই/
সেদিনই জাহিদ ভেবে নিলো ক'দিন ছুটি নেয়া দরকার। খুব বেশি ছুটি ও কাটায়নি বলে ছুটিটা পেয়ে গেল। ১০ দিনের ছুটি! জাহিদ অনেক খুশি হলো। কিন্তু দিন যায়, রাত যায় মেসেজ আসেনা। স্বেচ্ছায় নক করতেও পারছেনা। অবশেষে দুইদিন পর সকাল নয়টায় মেয়েটা আবার জাহিদকে মেসেঞ্জারে নক করলো,'আস্ সালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?'
সালাম এবং কুশল একসাথে দেখে জাহিদের মন ভরে গেল। কারো কারো একটা বাক্যও এমন হয় যেটা দেখার পর মানুষ দশ দিনের ছুটিও নিতে পারে সেই অপরিচিতার জন্য! অনায়াসে অনেকগুলো রাতও জাগতে পারে; আর এও বলে দিতে পারে,'ও কিছু নয়। আমি তো রোজই রাত জাগি। আসলে আমার ঘুম কম হয়।' জাহিদ কানে এয়ারফোন লাগালো। প্রিয় গানটা কানে বাজছে। সে মুহূর্তে ও জবাব দিলো,'ওয়ালাই কুম আস্ সালাম। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?'
'ভালো। আপনার লেখা আমার খুব ভালো লাগে ভাইয়া! আপনার কোনো লেখা নিউজফিডে না দেখলে আমার কেমন শূন্য শূন্য লাগে!'
জাহিদ ভেতরে ভেতরে চমকে গেল।
'আচ্ছা, মানুষ এমন করে লিখে কিভাবে?'
'আরেহ্! দেখুন, এতোটা প্রশংসা নিষ্প্রয়োজন।'
'প্রয়োজনীয়টুকুই
'জ্বী।'
'কিন্তু আপনি কমেন্টে সবার সাথে অত সুন্দর করে কথা কেনো বলেন?'
'কেনো? সমস্যা?'
'জ্বী, ভেতরে কোথায় যেন গিয়ে লাগে খুব!'
জাহিদ বুঝতে পারলো মেয়েটা সম্ভবত অনেকদিন ধরেই ওকে ফলো করছে। নইলে কমেন্টে কি বলি তা জানে কেমন করে? যাইহোক, এভাবেই একটানা কয়েকদিন কথা চলতে থাকলো। সারাদিন রাত একটু বিরতি নিয়ে নিয়ে দু'জনের চ্যাট চলতে থাকে। নিশু অপেক্ষায় থাকে কখন জাহিদ নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বলবে। আর জাহিদও ভাবে কখন নিশু ওকে নক করবে। কখনো শেষরাতে নিশুর মেসেজ আসে, 'এখনো ঘুমাননি? এরকম করলে শরীর খারপ করবে না?'
জাহিদ হুট করে বলে দেয়,'ও কিছু নয়!আমি তো রোজই রাত জাগি। সকালের দিকে একটু ঘুমাই। ও আমার অভ্যাস আছে।' জাহিদ বলতে পারেনা, ও যে নিশুর মেসেজ আসবে ভেবেই রাতে ঘুমাতে পারেনা। জাহিদের ছুটি ফুরোয়। সারাদিনরাত কথা বলার সুযোগ আর হয়না এখন। রাতেই একটু কথা হয়। এরই মধ্যে একদিন নিশু ওর চোখের ছবি পাঠায় জাহিদের ইনবক্সে। জাহিদ বলে,'আমি তো আপনাকে দেখতে চাইনি! তবু ছবি..? আপনি আমার না দেখা ভালোবাসা হতে পারতেন তো! পারতেন না?'
'আপনি! আপনি না... একটা মায়া!'
'তাই? তাইবুঝি মায়া করে আপনার চোখের ছবি পাঠিয়েছেন?'
'ইচ্ছে করেই দিয়েছি। সেদিন আপনি ভুল করে আপনার ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন; না? আমি কিন্তু ভুল করে দিইনি!' মেসেজটির সাথে হাসির ইমোজি দেখে জাহিদ লজ্জা পেতে থাকে। ভাবে: ও যে ইচ্ছে করে নিশুকে ওর ছবি পাঠিয়ে লিখেছে যে ভুলে ছবিটা চলে গেছে; -বিষয়টা কি নিশু টের পেয়ে গেছে? সেদিন সকালে অফিস যাবার সময় নিশুর চোখের ছবিটা স্টুডিওতে দিয়ে গেল বাঁধাই করে দেবার জন্য। জাহিদ পণ করে নিয়েছে ওর বেডরুমে সারাজীবন নিশুর এই চোখের ছবিটি থাকবে যদিও ও চোখ দু'টো সুন্দর না-কি অসুন্দর সেটা জাহিদ একবারো খেয়াল করে দেখেনি। যেমনই হোক এটা নিশুর চোখ! এটা ওর জীবনের একটা সম্পদ। এটা সেই সম্পদ যেটার মায়ায় হোঁচট খেলে মানুষ আর সেখান থেকে উঠে আসতে পারে না। জাহিদ ভাবলো,'মেয়েটা কি জানে কতোটা মায়া পড়ে গেলে ভারচ্যুয়ালকে সবচে' সত্য মনে হয়? ও কি ভালোবাসা বুঝে? ও কি জানে আমি জাহিদ বাক্য দেখে বক্ষ বুঝি? ও কি জানে আমি ওর বাক্যের প্রেমে পড়লেই সমস্ত আমি'কে ওর নামে লিখে দিতে পারবো? জানে ও?' হয়তো জানে কিংবা জানে না। না জানার মধ্য দিয়েই ওদের বন্ধুতা চলতে থাকলো। ভারচ্যুয়ালে এমন বন্ধুতা রোজ কুড়িয়ে পাওয়া যায়। এমন মায়া কিংবা মায়াবী বাক্যও কুড়িয়ে পাওয়া যায়। --এটা জাহিদ জানতো কিন্তু মানতো না। মোবাইলে স্পর্শ করলেই ওর মনে হতো ও যেন নিশুর আঙুল ছুঁইছে! ফেসবুকে কারোর প্রোফাইল ঘাটাঘাটি করার অভ্যাসটা কখনোই জাহিদের ছিল না। কিন্তু নিশুর প্রোফাইলটা রোজ একবার করে ঘেটে না দেখলে ওর ঘুম হতো না। বড়ো অক্ষরে লিখা "নাজনীন হোসাইন নিশু" এটুকু না দেখলে ওর শ্বাস নেয়া কঠিন হয়ে যেতো।ওর প্রোফাইলে ঢুকেই জাহিদ জানতে পারে যে, নিশু কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে থাকে। ওর মা-বাবা বেঁচে নেই। কম বয়সেই যাঁরা মা-বাবাকে হারায়, তাঁরা তো এমনিতেই একেকটা মায়ার ডিব্বা। উপরন্তু, নিশুর বাক্য গুলোতে কি মায়া! সব মিলিয়ে জাহিদ দিনকে দিন খুব আটকে যাচ্ছে নিশু'তে।
নিশু ভাই-ভাবী'র সংসারে থাকে। ভাইয়ের মেয়েটা ওর জীবন। নিশুর ভালো লাগা ছবিগুলো দেখতে পায় জাহিদ। অনেকগুলো ছবি- শরতের আকাশ, জোছনা রাত, নারকেল পাতার ওপারে একাকী চাঁদ, ঝাউবন, সমুদ্র, গোধূলীর রং মেখে থাকা নাম না জানা কতো কতো গাছের ছবি! প্রতিটা ছবির ক্যাপশনে লিখা ''আমার ভালো লাগা"। জাহিদ নিশুর ভালো লাগা প্রতিটা ছবি সেভ করে বাঁধাই করে বেডরুমে সাজিয়ে রেখে দেয়। সমস্ত প্রোফাইলের কোথাও নিশুর নিজের কোনো ছবি আপলোড করা নেই। অবশ্য জাহিদ জানতো ফেসবুকে নিজের ছবি বা সেলফি দেয়াটা নিশু'র পছন্দনীয় নয়।তবে নিশু'র হাতের একটা ছবি দেয়া আছে: গোলাপি রঙের দশটা আঙুল! হাতের মুঠো ভরা বকুল ফুল!
*
সেদিন অফিস থেকে রুমে ঢুকতেই দেখে মৌমিতা বসে আছে গাল ভারী করে। জাহিদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, 'তুমি?'
'কেনো? আসা নিষিদ্ধ?'
'নাতো। একদম সিদ্ধ।'
'কোনো খোঁজ নেই তোমার। কেনো?'
'তোমার সাথে তো আমার ঝগড়া হয়েছে। তো খোঁজ দেব কেনো?'
'আমার সাথে একটু ঝগড়া হয়েছে বলেই কি অন্য মেয়েকে ট্যাগ করে প্রেমের কবিতা লিখতে হবে?'
'বাহ্! এই ফেসবুকে কে কাকে ট্যাগ করছে, কে কাকে কমেন্টে মিষ্টি করে জবাব দিচ্ছে এসব ছাড়া তোমার চোখে আর কিছু পড়েনা? পুরো দুনিয়া কি এখন ফেসবুকে ঢুকে গেছে না-কি?'
'এটাই আমারও কথা।'
'কেনো?'
'জাহিদ! কেনো সেটা জানো না?'
'না।'
'ভালো।'
'তুমি কি আরেক তরফা ঝগড়া করার জন্যই আজ বাসা পর্যন্ত চলে এসেছো?'
'নাহ্! শুধু জানতে এসেছি-- এই নিশু মেয়েটা কে? তোমার সাথে ওর কিসের সম্পর্ক?'
'ও আমার বন্ধু।'
'তাই? খালি বন্ধুর জন্য এতো মায়া! এতো মায়াময় কবিতা লিখা?'
'হুম।'
'আমি ভাবতেও পারিনা জাহিদ! একজন সরকারি কর্মকর্তা এবং লেখক হয়ে তুমি কি এক অনলাইনের অপরিচিত মেয়ের সাথে কথা বলে চলছো অবিরাম; তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখছো; একেবারে বেহায়ার মতো নেতিয়ে পড়ছো তাঁর প্রতি। কেনো? ন্যূনতম মুডটাও কি নেই তোমার?'
'বারে! লেখক, সরকারি কর্মকর্তা এদের বুঝি খুব মুড থাকা লাগে?'
'লাগে।'
'ধুর! লাগবেনা আমার ওইসব মুড ফুড।'
'তুমি কি নিশুর পোস্টের কমেন্টগুলো দেখেছো কখনো?'
'নাতো!'
'দেখো। দেখতে পাবে সাদাফ নামের একটা ছেলের সাথে ওর কি রকমের কথোপকথন চলে। আমি নিশ্চিত নিশু সাদাফকে ভালোবাসে।'
'বাসুক। সমস্যা কি?'
'সমস্যা নেই?'
'নাহ্।'
'যাক্ সাহেব, তাহলে সত্যিই আপনি নিশুকে বন্ধুই ভাবেন!'
মৌমিতা মিষ্টি করে হাসে। একসাথে ডিনার শেষ করে মৌমিতাকে ওর বাসায় ড্রপ করে দিয়ে আসতে আসতে রাত দেড়টা বেজে যায়। রুমে ঢুকেই জাহিদ ডাটা অন করে। নিশুর একটা মেসেজ এসেছে,'কই ছিলেন আজ? রাতে একবারো পাইনি। খুব মিস করেছি! আপনাকে আজ আমার দরকার ছিল। আজ আমার মন খারাপের দিন ছিল।' মেসেজটা বারোটা দুই মিনিটে এসেছে। এখন দুইটা বাজে প্রায়। নিশু এখন আর অ্যাকটিভ নেই। জাহিদ ওর প্রোফাইলে ঢুকে কমেন্টগুলো দেখতে লাগলো। সত্যিই সাদাফ নামের ছেলেটার সাথে কমেন্টে ওর কথোপকথন সন্দেহজনক। জাহিদ ভেবে নিলো, এই ছেলেটার সাথে নিশুর প্রেমের সম্পর্ক থাকতেও পারে। জাহিদের ভীষণ মন খারাপ হলো যদিও এ বিষয়ে ও একদমই মন খারাপ করতে চাচ্ছিলো না। অনেক ছাইপাশ বুঝিয়ে মনটাকে শান্ত করলো ও। নিশু অন্য কাওকে ভালোবাসে -এটা ভেবে যে ওর মন অশান্ত হয়েছিল কোনো একদিন --এই বিষয়টা নিশুকে কিছুতেই কখনো বুঝতে দেয়া যাবে না। একটু একটু করে রোজ কষ্ট পেলেও বুঝতে দেয়া যাবেনা। ঐ সপ্তাহের শুক্রবারে ভোরবেলা উঠেই জাহিদ কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলো। বাসে বসেই নাস্তা করলো। ঢাকার প্রথম প্রান্ত থেকে কুমিল্লা খুব কাছের পথ নয়।ওখানে ওর কোনো কাজও ছিল না।শুধুমাত্র ক্যান্টনমেন্টের
'কি বলে!আগে জানাবেন না? দেখা করা যেতো!'
'আসলে কুমিল্লাতে একটা কাজ ছিল তো!গিয়েই চলে এসেছি।'
*
একদিন জাহিদ নিশুকে একটা মেসেজ পাঠালো,
'আপনার চোখ দু'টো কাজল পড়ার চোখ। কাজল পড়লে আপনাকে খুবই সুন্দর লাগবে। কখনো নিজের চোখ দু'টো দেখেছেন?- কি গাম্ভীর্যের মায়ায় অটল দু'টি চোখ! দেখেছেন?'
নিশু জবাবে লিখলো,'ও চোখ আমার ছিল না।'
'আপনার ছিল না?'
'না।'
'আমার সাথে আপনি মিথ্যে বলতে পারলেন?কেনো বলেছিলেন ওটা আপনার চোখের ছবি?এটুকু মিথ্যা বলার কি দরকার ছিল?'
'আমি সব পারি।আমি এমনই।'
জাহিদ কি জবাব দিবে ভেবে পেল না।কিছু লিখার শক্তিও পেল না।ঠিক কোথায় যেন খুব করে কোন একটা কিছু ভাঙনের শব্দ টের পেল। সে ভাঙন থেকে উঠে দাঁড়ানো কঠিন।
দুই সপ্তাহ্ গেল। ওদের মধ্যে কোনো কথা হলো না। তারপর একদিন নিশুই জাহিদকে নক করলো,'আস সালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?'
জাহিদ জবাব দিলো,'কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। তবুও তো সালাম ফেরানো উচিত। ওয়ালাইকুম আস্ সালাম। That means শেষ সালাম। এটাই শেষ কথা। আর কোনো কথা বলতে চাইনা আপনার সাথে মিথ্যেবাদী কোথাকার!'
তখনই নিশু কোনো জবাব দিল না। ঘণ্টাখানিক পর লিখলো,'আমায় ক্ষমা করবেন। সেদিন মনটা খারাপ ছিল। কি থেকে কি বলেছি জানি না। তবে,ওটা আমার চোখের ছবিই ছিল। আমি মিথ্যে কথা বলি নাই।'
জাহিদ লিখতে চাইলো,'নিশু, আমি তো আপনাকে হাজারবার ক্ষমা করতে পারি।' কিন্তু সেটা লিখে সেন্ট করার উপায় নেই। নিশু ঐ মেসেজটা লিখেই জাহিদকে ব্লক করে দিয়ে চলে গেছে।
*
অনেকদিন ধরেই মৌমিতা জাহিদের মন খারপের বিষয়টা লক্ষ্য করে একদিন বললো,'এরকম মনমরা হয়ে কেনো থাকো? আমাকে যদি তোমার অযোগ্য মনে হয়, তো তুমি নিশুর কাছে ফেরত যেতে পারো।'
জাহিদ আস্তে করে বললো,' ফেসবুকের একটা ব্লক অপশনই যার কাছে একটা সম্পর্ক ভাঙার হাতিয়ার,তাঁর কাছে মানুষ কি ফেরত যেতে পারে?'
'কি বললে?'
'কিছু না। তুমি টেনশন কোরো না। আমি ভালো আছি।'
মৌমিতা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললো,'ঠিকআছে, আসছি আমি।'
জাহিদ বারবার ইনবক্স চেক করে। বারবারই দেখে ও ব্লক লিস্টেই আছে। অপমান না-কি অভিমানে ওর নিজের কাছে নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে অযোগ্য ব্যক্তি বলে মনে হতে থাকে। সমাজের যোগ্যতম ব্যক্তিটি যখন নিজেকে এমন অযোগ্য ভাবতে পারে, তখন বোঝা যায়,ব্যক্তিটি ভালোবেসেছে। এমন ভালোবাসা যেটা কখনোই ছোঁয়া যায়না। বিশাল আকাশের মতো বিস্তৃতি নিয়ে আজন্ম যে ভালোবাসা সাথে বয়ে চলে। তবুও ছোঁয়া যায় না। তবুও অপূর্ণতায়, আকাঙ্ক্ষায় ভেতর কাঠ হয়! হুট করে চলে যাওয়া সেই মানুষটাকে ভেতর পোড়ানো এই অনুভূতিটুকু কখনোই জানানো হয়না। জাহিদও নিশুকে জানাতে পারেনি কতোটা পুড়ে চলছে ওর ভেতরটা!
জানানোর কোনও উপায় নেই।
*
জাহিদের সেই বটগাছটির কথা মনে পড়লো। ওর বাসা থেকে একটু দূরে কালি মন্দিরের পাশে একটা বয়স্ক বটগাছ। জাহিদ ছোটোবেলা থেকেই ভাবে, এই বটগাছটি ওর সাথে কথা বলে যে কথা ও ছাড়া আর অন্য কেউ শুনতে পায় না। জাহিদ মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছিল। বটের পাতাগুলো ভিজে আছে। কয়েকটা পাখি ভেজা শরীরে বসে আছে। ডাকছে না। ওদের এখন ডাকার মতো শক্তি নাই। বিকেল বেলার বৃষ্টিগুলো সবাইকেই কেমন দুর্বল করে দেয়! জাহিদ বিড়বিড় করে, 'আজ ২৫ শে মে!'
'হুম বাছা।'
'এক বছর আগে আজকের দিনেই নিশু আমাকে নক করেছিল।'
'হুম।'
'দুইমাস পর অগাস্ট মাসে ওর জন্মদিবস। আমার খুব সাধ হয়েছিল ওকে জন্মদিবসে উইশ করবো।'
'হুম।'
'পরজনম আছে?'
'না।'
'কেনো নেই?'
বটগাছ থেকে দৈব হাসির শব্দ ভেসে আসে--
'হাহাহা। কেনো থাকবে?'
'নিশু বকুল ভালোবাসে। বকুল তাঁর খুব প্রিয়। পরজনমে আমি বকুল হয়ে ঝরবো! নইলে আমি কুকুর জীবন চাই। সে কুকুর পোষে। তাঁর পোষা কুকুর হতে চাই। মানুষ হয়ে যাঁর পাশে থাকার অধিকার পাইনি, তাঁর পাশে থাকার জন্য কুকুর হয়ে জন্মানোর যোগ্যও কি নই আমি? তাঁর গৃহের পাশ কেটে যে কুকুরটি রোজ হেঁটে যায়, আমি সেই কুকুর হতে চাই। পরজনমে আমি কুকুর জীবন চাই!'
সারা স্কুল তন্ন তন্ন করে খোঁজার পরও যখন আনিশাকে পাওয়া গেল না, তখন জাহিদ প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকলো। প্রধান শিক্ষক রতন কর্মকার ওর ছোটোবেলাকার বন্ধু। বললো,'রতন, আনিশাকে নিতে এসেছি। কিন্তু ওকে কোথাও পাচ্ছি না!'
'ও তো তুলির সাথে গেছে।'
'মানে?'
'আমার রুমে এসে অনুরোধ করলো যেন আমি ওকে তুলির বাসায় যাবার অনুমতি দেই। আর তুই খুঁজতে এলে যেন বলে দিই। টেনশন করিস না। কাছেই তুলিদের বাসা।'
'যেতে চাইলো আর অমনি তুই যেতে দিলি?'
'কি করবো বল্?কান্না শুরু করেছিল। ভাবলাম বাচ্চা মানুষ! যেতে চাইছে যাক্। তাছাড়া তুলি'র মা এসে ওদেরকে নিয়ে গেছেন।'
'তুলিদের বাসার ঠিকানা দে।'
'এই তো ক্যান্টনমেন্ট গেইটে গিয়ে বললেই হবে। ওরা দেখিয়ে দিবে। তুলির মা-বাবা, মামা-মামী পুরো ফেমিলি ওখানে থাকে। ওখানকার সবাই তুলিকে চিনে। যে কাওকে বললেই দেখিয়ে দেবে।'
জাহিদ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লো। ক্যান্টনমেন্টের
বাসায় ঢুকে জাহিদ ডাকতে লাগলো,'আনিশা, আনিশা...'
আনিশা উপর তলা থেকে নেমে এলো। মন খারাপ করে বললো, 'তুমি কেনো এসেছো পাপা? আমাকে নিতে? আমি যাবো না। আমি আজকে তুলির সাথে থাকবো।'
'তোমার মা চিন্তা করবে। চলো, থাকা যাবেনা।'
পেছন থেকে একটা মহিলা গলা শোনা গেল,'থাকতে চাইছে যখন থাকুক না! কোনো সমস্যা হবে না। বাচ্চাদের মন ভাঙাটা কি ঠিক হবে?'
জাহিদ পেছনে তাকালো। সালাম দিয়ে বললো,'আমি মোঃ জাহিদ হাসান, আনিশার বাবা।'
মহিলা মৃদু হেসে বললো,' নামটা জানি। আমি নাজনীন হোসাইন নিশু, তুলি'র মা।'
জাহিদ এতোক্ষণ পরমহিলা ভেবে ও মহিলার চোখে তাকায় নি। তাকালে হয়তো নাম বলার আগেই চিনতে পেতো। ঐ চোখ দু'টি ওর আত্মস্থ। জাহিদ ভেতরে চমকে উঠলেও বাইরে স্বাভাবিক থাকলো। নিশু বললো,'কবে থেকে কুমিল্লাতে আছেন?'
'বছর পাঁচেক আগে বদলি হয়ে এসেছি।'
নিশু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, 'বিধাতা অবশেষে এই মিথ্যাবাদী'র বাসা পর্যন্ত নিয়ে এলো আপনাকে!'
এই দীর্ঘশ্বাসে কি ছিল, কি আছে জাহিদ জানেনা; বুঝতেও পারেনা। ভার্চুয়্যালকে বোঝা বড়ো কঠিন!
'আনিশা থাকুক তাহলে। আগামী কাল স্কুলে নিয়ে যায়েন ওদেরকে। আমি ওখান থেকেই আনিশাকে নিয়ে যাবো।'
'খুব তাড়া? লাঞ্চ করে যান?'
'পেটে সইবে না।'
'একদিন নাহয় না সইলো!'
জাহিদ আর কথা বাড়াতে চাইলো না। 'আসি' বলেই ও বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো।
বাসার সামনে বকুল গাছটা দেখে জাহিদের চোখ ভিজে গেল। চোখ থেকে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো চুপচাপ! ফোঁটায় ফোঁটায় ভেসে থাকে খুব যত্ন করে রাখা সেই নাম "নিশু!" আল্লাহ্ পাক জানেন, এটা পাপ। বৌ জানে, এটা প্রতারণা। দুনিয়া জানে, এটা অন্যায়। আনিশা জানে, এটা অভাবনীয় কষ্ট। কেবল জাহিদ জানে, এটা ভালোবাসা!!!
***
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট! কতো সাজানো গোছানো খণ্ড খণ্ড বাগান! পাতা বাহারের ছোটো ছোটো পাতাগুলো নড়ছে। ভদ্র বাতাস মিলমিল করে বইছে! জাহিদের আস্ত শরীর উত্তাপে ভরে আছে। নিজেকে বাতাসের কাছে মেলে ধরলো ও। একটু একটু করে বাতাস এসে ওকে ছোঁয়। জাহিদ শ্বাস টানে। ছোটো ছোটো নিঃশ্বাসের সাথে ভেতর থেকে একটা একটা করে আকাঙ্ক্ষা বেরিয়ে আসে...!
বেঁচে থাকা পৃথিবীতে বোধহয় প্রতিটা মানুষের নিঃশ্বাস থেকেই এরকম দু' চারটা আকাঙ্ক্ষা বের হয় যেগুলো কখনোই পূর্ণ হবার নয়; যেগুলো অপূর্ণ থাকতে থাকতেই বয়সটা বেড়ে চলে। মানুষের বয়স বাড়ে! মানুষ মরে যায়!
0 Comments
Thanks for your valuable comment. We will be back soon.
Thank you 😊😊😊