যে সত্যবাদী সে অবশ্যই সভ্য

Ads Inside Post

যে সত্যবাদী সে অবশ্যই সভ্য

সভ্য বা Civilized শব্দটি ইদানিং আমরা খুব গর্বের সাথে ব্যবহার করি। যথেষ্ট সভ্য হয়েছি বলে বড়াই করি। সভ্যতার চাকায় ঘুরে আমরা একবিংশ শতাব্দীর ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাচ্ছি, কিন্তু আদৌ কি সভ্য হয়েছি? প্রতিনিয়ত কম্পিউটার আপডেটের মতো হয়তো আমরা প্রযুক্তিগতভাবে আপডেট হচ্ছি কিন্তু নৈতিকতার বিচারে আমাদের চারিত্রিক আপডেট কি আদৌ হয়েছে? যা কিছু ভালো, তার সবকিছু প্রতিনিয়ত অতীত হয়ে যাচ্ছে। সেই গানটির মতো ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। হিসাব কষলে দেখা যাবে নৈতিকতার বিচারে আমদের আপডেট ক্রমশঃ অধঃপতনের দিকে দ্রুতলয়ে এগিয়ে চলছে। এর একটা অন্যতম কারন মনে হয় মিথ্যাশ্রয়ী জীবন চর্চা। কি ব্যক্তি, কি রাষ্ট্রীয় - সর্বত্র চলছে মিথ্যার প্রতিযোগিতা। রাজনীতি যেন মিথ্যা ছাড়া অচল। বরং মিথ্যাকে সত্য হিসাবে চালিয়ে দিতে এরা পারদর্শিতার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। এক শিয়াল 'কেক্কা হুয়া' বললে বাকি শিয়াল যেমন তারস্বরে কেক্কা হুয়া ডাক শুরু করে ঠিক তেমনি নেতা একটা মিথ্যা বললে চামচারা এর সাথে আরো দশটা যোগ করে কিভাবে এটা সত্য বানানো যায় এই প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়। মাছ কিনতে গেলে মানুষ মাছের কানখা দেখে - কেন? কারণ মাছের পচন মাথা থেকে শুরু হয়, তাই। সমাজের পচনটা ও শুরু হয়েছে মাথা থেকে। সদা সত্য কথা বলিবে’ ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’- এ কথাগুলো জীবনের একদম প্রারম্ভে, শিশুকালেই আমাদেরকে শেখানো হতো। কারণ, মিথ্যে মানেই বিভ্রান্তি, ছলনা। মিথ্যার বিভীষিকা সমপর্কে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘মিথ্যারও মহত্ত্ব আছে। হাজার হাজার মানুষকে পাগল করে দিতে পারে মিথ্যার মোহ। চিরকালের জন্যে সত্য হইয়াও থাকিতে পারে মিথ্যা’। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে দেখতে গেলে, প্রায় প্রতিটি ধর্মগ্রন্থে মিথ্যা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। নীতিগতভাবে ভাবতে গেলেও, মানবজীবনে মিথ্যার গ্রহণযোগ্যতা নেই। তবুও, জীবনের নানা ক্ষেত্রে অনেকেই ছোটখাটো মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। এটি নিয়ে খুব বেশি বিচলিতও হন না। এ নিয়ে একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে: ‘মিথ্যা জীবনের সত্যের একটা অংশ’। অনেকেই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মিথ্যার আশ্রয় নেই। কারণ হিসেবে বলি, সত্যের আঘাত থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিলে মন্দ কী? তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সত্যি কী আসলেই কখনো কখনো ঝামেলা তৈরি করে? যদি করেও, তা কি মিথ্যে বলার ঝামেলার চেয়ে বেশি? জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করলে দেখা যায়, মিথ্যা আরো বেশি নেতিবাচক ফলাফল ডেকে আনে। এর কারণে বিশ্বাসে ফাটল তৈরি হয়, সম্পর্কে জটিলতা আসে, গোলযোগ বাধে জীবনে। তবুও মানুষ মিথ্যা বলে। কেন বলে? অধিকাংশ মানুষ মিথ্যা বলেন নিজেদের ভালো কিংবা নির্দোষ প্রমাণ করতে। কেউ কেউ হয়তো অন্যকে কষ্ট না দেয়ার জন্য কিংবা সামাজিক মর্যাদা অর্জন বা ধরে রাখার জন্য মিথ্যা বলেন। কারণ, যা-ই হোক, মিথ্যার আশ্রয় নেয়াটা কখনোই আদর্শ কাজ নয়। সামপ্রতিককালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মিথ্যা বলা ব্যক্তির নিজের জন্যই চরম অমঙ্গলকর। ছোটখাটো মিথ্যার আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিও এক সময় ধীরে ধীরে মিথ্যা কথা বলায় আসক্ত হয়ে পড়েন! বৃটেনের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের একদল বিজ্ঞানী গবেষণায় খুঁজে পেয়েছেন যে, মিথ্যা কথা বলা ব্যক্তির মস্তিষ্ক এতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। প্রতিটি মিথ্যা কথার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির মিথ্যা কথা বলা সংক্রান্ত অপরাধবোধ অবলুপ্ত হতে থাকে। মস্তিষ্কে তৈরি হয় মিথ্যা বলার গ্রহণযোগ্যতা। এর ফলে ব্যক্তি ধীরে ধীরে মিথ্যা কথা বলার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। আর এর সবই হয় ব্যক্তির অজান্তে। গবেষকগণের একজন- ড. টালি শ্যারন বলেন, শুনতে অদ্ভুত হলেও সত্যি যে, প্রতিটি ছোটখাট মিথ্যা আমাদের মস্তিষ্ককে বড় ধরনের মিথ্যা বলার জন্য প্রস্তুত করে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার প্রখ্যাত মনোবিদ বেলা ডিপাউলো বলেন, একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে- বেশির ভাগ মানুষ দিনে গড়ে এক থেকে দুটি মিথ্যা কথা বলেন। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, বৈশ্বিকভাবে প্রতিদিন আমাদের মস্তিষ্ক একটু একটু করে মিথ্যায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। এ বড় ভয়ের কথা। কারণ, সামগ্রিকভাবে এই প্রবণতা কেবল অমঙ্গল ডেকে আনবে। সুতরাং, যারা সত্যবাদী এবং সৎ জীবনযাপন করতে চান, তাদের উচিত মিথ্যা থেকে দূরে থাকা। মনে রাখতে হবে, প্রাত্যহিক জীবনের ছোটখাটো যেসব অসত্যকে ‘নিষ্পাপ বা ক্ষতিহীন মিথ্যা’ নাম দিয়ে স্বাভাবিক বলে চালিয়ে দিচ্ছেন, সেটিই একসময় আপনাকে বড়সড়ো মিথ্যাবাদীতে পরিণত করে দিতে পারে। জানি, আমরা কেউ-ই ইচ্ছাকৃতভাবে এমনটা হতে চাই না। তবে ভয়ের কথা হচ্ছে, মিথ্যা বলার অভ্যাস আপনার অজান্তেই আপনাকে ঠেলে দেবে মিথ্যের ঝামেলাপূর্ণ জগতে। এটাই মিথ্যে বলার সত্যিকারের সমস্যা। মিথ্যা সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : ‘মিথ্যাবাদীদের উপর অভিসম্পাত।' (আল-ইমরান-৬১)। সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদীতা মানুষকে সততার পথে টেনে নিয়ে যায়, আর সততা টেনে নেয় জান্নাতের দিকে। কোন ব্যক্তি ক্রমাগত সত্য বলতে থাকলে এবং সত্যের পথ অন্বেষণ করতে থাকলে এক সময় তাকে সিদ্দিক তথা ‘পরম সত্যনিষ্ঠ' বলে সে আল্লাহর কাছে লিপিবদ্ধ হয়। আর মিথ্যা মানুষকে পাপাচারের দিকে এবং পাপাচার জাহান্নামের দিকে টেনে নেয়। আর কোন ব্যক্তি ক্রমাগত মিথ্যা বলা ও মিথ্যার পথ অন্বেষণ করতে থাকলে এক সময় আল্লাহর দরবারে সে ‘মিথ্যুক' হিসাবে লিখিত হয়। সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তিনটি জিনিস মুনাফিকের নিদর্শন, সে যতই নামায-রোযা করুক এবং নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করুক, তাহলো কথা বললে সে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে তা খেলাফ করে এবং আমানত রাখলে তার খেয়ানত করে।' বুখারীর অন্য বর্ণনায় আছে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘চারটি দোষ যার ভেতরে থাকবে সে পাক্কা মুনাফিক। আর যার ভেতরে এর একটি থাকবে, সে তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার ভেতরে মুনাফেকির একটি আলামত থেকে যাবে। আমানতের খেয়ানত করা, ওয়াদা খেলাফ করা, মিথ্যা বলা ও ঝগড়ার সময় গালিগালাজ করা।' সহীহ বুখারীতে যে দীর্ঘ হাদীসে রাসূল (সা.)-এর স্বপ্নের বৃত্তান্ত দেয়া হয়েছে, তার এক জায়গায় রাসূল বলেন, ‘এক শায়িত ব্যক্তির কাছে আমরা উপস্থিত হলাম। দেখলাম, এক ব্যক্তি তার পাশে দাঁড়িয়ে লোহার একটি অস্ত্র দিয়ে একবার তার ডানপাশের চোয়াল ও চোখ একেবারে পেছন পর্যন্ত ফেড়ে দিচ্ছে। তারপর যখনই বাম দিকে অনুরূপ ফেড়ে দিচ্ছে, তখন ডান দিকটা আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। আবার ডান দিকে পুনরায় চোয়াল ফেড়ে দিলে বাম দিক ভালো হয়ে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম : এই ব্যক্তি কে? আমার সঙ্গী ফিরিশতাদ্বয় বললেন, সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা গুজব রটিয়ে ছেড়ে দিতো এবং তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত।' আর একটি হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কারো সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করো না। কেননা খারাপ ধারণা জঘন্যতম মিথ্যাচার।' (বুখারী ও মুসলিম)। মুসলিম শরীফে আছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির সাথে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদের দিকে দৃষ্টি দেবেন না এবং তাদেরকে গুনাহ থেকে পবিত্র করবেন না, তারা হলো ব্যভিচারী বৃদ্ধ, মিথ্যুক শাসক এবং অহংকারী দরিদ্র।' মিথ্যার মধ্যে অধিকতর মারাত্মক হচ্ছে মিথ্যা শপথ। আল্লাহ তায়ালা এটিকে মুনাফিকদের স্বভাব বলে অভিহিত করেছেন : ‘মুনাফিকরা জেনে শুনে মিথ্যা শপথ করে।' তিরমিযি শরীফে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘তিনজনের সাথে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন কথাও বলবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না, অধিকন্তু তাদের জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারণ থাকবে, তারা হলো যে ব্যক্তির উদ্বৃত্ত পানি আছে, কিন্তু পথিককে তা ব্যবহার করতে দেয় না, যে ব্যক্তি খরিদ্দারকে মিথ্যা শপথ করে বলে যে, আমি এত দামে কিনেছি, আর খরিদ্দার তা বিশ্বাস করে তা অধিক মূল্যে কিনে নেয়, অথচ আসলে সে সেই দামে তা কেনেনি এবং যে ব্যক্তি কোন নেতার প্রতি নিছক দুনিয়াবী স্বার্থের জন্য আনুগত্য করার ওয়াদা করে, অতঃপর নেতা তাকে স্বার্থ দিলে সে তার আনুগত্য করে, নচেৎ করে না। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তোমাকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করে, তার সাথে মিথ্যা কথা বলা নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতকতা।' রাসূল (সা.) আরও বলেন, ‘আল্লাহর সাথে সবচেয়ে বড় জালিয়াতি হলো কোন ব্যক্তি যা দেখেনি, তাই দেখেছে বলে দাবি করা।' অর্থাৎ সে বলে আমি এরূপ স্বপ্নে দেখেছি অথচ তা সে দেখেনি। হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, কোন বান্দা ক্রমাগত মিথ্যা বলতে থাকলে তার হৃদয়ে প্রথমে একটা কালো দাগ পড়ে, অতঃপর সে দাগ বড় হতে হতে পুরো হৃদয়টা কালো হয়ে যায়। তখন আল্লাহর কাছে তাকে মিথ্যাবাদী লেখা হয়। সুতরাং সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট কল্যাণ নিহিত আছে এমন অবস্থা ছাড়া কোন মুসলমানের কোন অবস্থাতেই মিথ্যা বলা উচিত নয়। তার উচিত হয় সত্য বলা, নচেৎ চুপ থাকা। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করে সে যেন ভালো কথা বলে নচেৎ চুপ থাকে।' এ হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কোন কথার কল্যাণকারিতা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত না হলে সে কথা বলা উচিত নয়। বুখারী শরীফের হাদীসে হযরত আবু মুসা (রা.) রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করেন, মুসলমানদের মধ্যে কে উত্তম? উত্তরে রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ জেনে শুনে হারাম বাক্য উচ্চারণ করে, সে জাহান্নামের এত নিচে নিক্ষিপ্ত হবে, যা পৃথিবীর পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত অপেক্ষাও দূরে অবস্থিত।' উল্লেখ্য যে, কারও প্রাণ রক্ষা, দু'পক্ষের কলহ প্রশমিত করা এবং দাম্পত্য সম্পর্কে ভাঙন রোধ করার প্রয়োজনে মিথ্যা বলার শুধু অনুমতি আছে তা নয়, বরং ক্ষেত্র বিশেষে তা অবশ্য কর্তব্য। তবে এরূপ ক্ষেত্রেও সুস্পষ্ট মিথ্যা বলার চাইতে দ্ব্যর্থবোধক কথা বলা ভাল। যেমন সাওর পর্বতগুহায় যাওয়ার সময় এক ব্যক্তি হযরত রাসূল (সা.) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো, তিনি কে? আবু বকর বললেন, উনি আমার পথ প্রদর্শক। জনৈক মনীষী বলেন, মানুষের ভেতরে প্রায় আট হাজার চারিত্রিক দোষ রয়েছে। কিন্তু একটি গুণ তার সব দোষ ঢেকে দিতে সক্ষম। সে গুণটি হলো বাকসংযম। আর একটি গুণ তার সব দোষ দূর করতে পারে। তা'হচ্ছে সত্যবাদীতা। যে সত্যবাদী সে অবশ্যই সভ্য। আল্লাহ আমাদের সত্য গ্রহণের ও মিথ্যা বর্জনের তাওফিক দিন।


Post a Comment

0 Comments