ক্ষুদিরাম হবে পাশের বাড়ির ছেলে

Ads Inside Post

ক্ষুদিরাম হবে পাশের বাড়ির ছেলে

golpo-ghar.blogspot.com
golpo-ghar.blogspot.com
 



"ক্ষুদিরাম হবে পাশের বাড়ির ছেলে

আমার ছেলে ডাক্তার হবে।

আমার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, নিদেনপক্ষে --

সরকারী অফিসার।


ক্ষুদিরাম হবে পাশের বাড়ির ছেলে

আমার ছেলে দেশ চালাবে। দেশ শাসন করবে।

গাড়ি চাপবে। সামনে ড্রাইভার

পেছনে চাপরাশি আর্দালি

গরমে কুলু মানালী। শীতে কোবালাম বীচ।


ক্ষুদিরাম হবে পাশের বাড়ির ছেলে।

দেশের জন্য লড়াই করবে ও পাড়ার ওরা--

আমার ছেলে ঘাড় গুঁজে ক্যারিয়ার বানাবে,

বিজ্ঞান শিখবে। অঙ্ক শিখবে, কবিতা শিখবে।

বড় বড় মণীষীদের জীবনী পড়বে।


দেশের জন্য মুখের রক্ত তুলবে ও পাড়ার ওরা

আমার ছেলে আমার রক্ত জল করা পয়সা

সুদে আসলে উসুল করবে।

নেতাজী সুভাষ হয়ে দুরন্ত দুঃসাহসে ঘর ছাড়বে

অন্য কেউ। আমার ছেলে নেতাজীর জীবনী লিখে

এ্যাওয়ার্ড পাবে।


ক্ষুদিরাম হবে পাশের বাড়ির ছেলে।

আমরা তামাকে এবং দুধে,

রসে এবং বশে, সুখে এবং আরামে

দিন কাটাবো।

দেশের মুক্তি, প্রাণের মূল্য কিনে আনবে অন্য কেউ।

আমরা মুক্ত স্বদেশে

ঘাড়ে পাউডার লাগিয়ে গদ গদ কন্ঠে

গণসঙ্গীত গাইবো।"


_"আমরা"(কবি- শুভ দাশগুপ্ত)


আধুনিক অভিভাবকেরা এই চিন্তা নিয়েই সন্তানদের বড় করেন।


“আমি আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছুই বলতে চাই না এবং শাস্তি এড়ানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই। ওরা আমাকে জেলে পাঠালে আনন্দিত হবো। যে ব্যান্তুি শাস্তি বা জেল বা ফাঁসির ভয়ে ভীত,সে মাতৃভূমির যোগ্য নয়”।

..... ক্ষুদিরাম বসু


১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিন বয়সী এক তরতাজা যুবক ফাঁসির আসামী।জেলার ফাঁসির আসামীকে প্রশ্ন করছে,

জেলার -- মৃত্যুর আগে তোমার শেষ ইচ্ছা কী?


আসামী -- আমি ভালো বোমা বানাতে পারি, মৃত্যুর আগে সারা ভারতবাসীকে সেটা শিখিয়ে দিয়ে যেতে চাই।


এই মৃত্যুঞ্জয়ী নিজের মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা শুনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে খিল খিল করে হেসে উঠেছিলেন। এই অভূতপূর্ব ঘটনায় স্তম্ভিত বিচারক জিজ্ঞাসা করলেন , '' তোমার ভয় করছেনা ? ''

 ইংরেজ বিচারককে আরও স্তম্ভিত করে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন , '' আমি গীতা পড়েছি । মৃত্যুভয় আমার নেই । '' 


এযুগের একজন ১৮ বছরের তরুনের কাছে এগুলো অবাস্তব/গল্প মনে হতে পারে কিন্তু ১৯০৮ সালে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু বাস্তবেই এমন দুঃসাহসী কাজ করেছিলেন। 


ক্ষুদিরামের ফাঁসি কার্যকর হয় ১৯০৮ সালের ১১ আগষ্ট। ঘড়িতে তখন ভোর ৪টা। সে সময় ক্ষুদিরামের পক্ষের আইনজীবি ছিলেন শ্রী উপেন্দ্রনাথ সেন। তাঁর ভাষ্যমতে -"ফাঁসির মঞ্চে ক্ষুদিরাম নির্ভীকভাবে উঠে যান। তাঁর মধ্যে কোন ভয় বা অনুশোচনা কাজ করছিল না। এদেশের নবীন যৌবনের প্রতীক হয়ে হাসিমুখে তিনি উঠে যান ফাঁসির মঞ্চে।" 


এই ঘটনা বাংলায় ব্যাপক আলোড়ন ফেলেছিল | ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির ঘটনার উপর নির্মিত হয়েছিল অজস্র লোকগান, কবিগান, টুসুগান, ভাদুগান, পটচিত্র | ক্ষুদিরামের ফাঁসির পর একরকম স্বদেশী ধুতি পাওয়া যেত, যার পাড়ে লেখা থাকত – একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি | বাঁকুড়ার পীতাম্বর দাস লিখেছিলেন এই গান – তারই প্রথম চরণ এটি | এই গান শোনেননি এমন বাঙালি বিরল | ১৯১০ সালের ১২ মার্চ ব্রিটিশরা ওই ধুতির পাড়ের বিক্রি নিষিদ্ধ করে। ক্ষুদিরাম বসুর আত্মবলিদান দিবসে অর্থাৎ ১১ই আগস্ট বাংলার ঘরে ঘরে উনুন জ্বলত না – পালন করা হত অরন্ধন | বাংলার ঘরে ঘরে রাখা হত ক্ষুদিরাম বসুর ছবি। এই ব্যাপারটা ব্রিটিশদের নজর এড়াল না। ক্ষুদিরাম বসুর ছবি যাতে বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছাতে না পারে, তাঁর জন্যে সচেষ্ট হল তারা। 


নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন কটকের কাঠাজুড়ি নদীর তীরে র‍্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র।বেণীমাধব দাস তখন সেই স্কুলের প্রধানশিক্ষক। দেশপ্রেম ও শিক্ষকতায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন বেণীমাধব দাস।তার হাতে তৈরী হয়েছিল অসংখ্য দেশপ্রেমিক বিপ্লবী। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও স্বদেশচেতনা গভীর ছাপ ফেলেছিল ছোট্ট সুভাষের মনে। বেণীমাধব দাসও চিনতে ভুল করেননি সুভাষকে। বুঝতে পেরেছিলেন এই ছেলের ভিতরে আগুন আছে | বেণীমাধব দাস সুভাষকে উদ্বুদ্ধ করেন স্বামী বিবেকানন্দের রচনা পড়তে। এর পাশাপাশি তিনি তাঁর সকল ছাত্রদের সক্রিয়ভাবে সমাজসেবায় অংশ নিতেও উৎসাহ দিতেন | ছাত্রাবস্থাতেই সুভাষচন্দ্রের মনে স্বদেশচেতনার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। ১৯১১ সালের ১১ই আগস্ট তিনি এবং তাঁর সহযোগীরা ঠিক করলেন শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর তৃতীয় শহীদ দিবস পালন করবেন। সেই সময়ে ক্ষুদিরামের ছবি পাওয়া ছিল দুষ্কর, কিশোর নেতাজী পুরোনো খবরের কাগজের থেকে বের করেছিলেন ছবি। তারপর তার সাথে বোর্ড জুড়ে তিনি ছবিটিতে মাল্যদানের উপযোগী বানান। সুভাষ স্কুলের ছাত্রদের কাছে উপবাস করে এই দিনটি পালন করবার প্রস্তাব দিলেন। তাঁর প্রস্তাবে সব ছাত্রই রাজী হ’ল।ঠিক হল ঐদিন স্কুলের হোস্টেলে উনুন জ্বলবে না। হলও তাই। সেদিন হাঁড়ি চড়ল না। স্কুলের সকলেই উপবাস করলেন। এটিই ছিল নেতাজির প্রথম নেতৃত্বদানের ঘটনা। প্রধানশিক্ষক বেণীমাধব দাস নীরবে সকলকে উৎসাহ দিতে লাগলেন। মনে মনে গর্বিত হলেন তিনি |


ক্ষুদিরামের ফাঁসি সময়ের একটা গানে আছে, 

ক্ষুদিরাম বলছে,--


আঠারো মাসের পরে

জনম নেব মাসির ঘরে, মা...গো...,

চিনতে যদি না পার মা

দেখবে গলায় ফাঁসি...

একবার বিদায় দে মা ফিরে আসি।


সেই হারা-ক্রন্দনের আশ্বাসের -গান শুনে আজও অতি বড় পাষণ্ড মেয়েদেরও চোখে জল আসে, গা শিউরে ওঠে। আমাদের মতো কাপালিকেরও রক্ত-আঁখি আঁখির সলিলে টলটল করে ওঠে। কিন্তু বলতে পারো কি দেশের জননীরা, আমাদের সেই হারা ক্ষুদিরাম তোমাদের কার ঘরে এসেছে? তোমরা একবার তোমাদের আপন আপন ছেলের কণ্ঠের পানে তাকাও, দেখবে –তাদের প্রত্যেকের গলায় ক্ষুদিরামের ফাঁসির নীল দাগ। ক্ষুদিরাম ছিল মাতৃহারা। সে কোন্ মাকে ডেকে আবার আসব বলে আশ্বাস দিয়ে গেছে, কেঁদে গেছে, তা যদি বুঝতে বাংলার মা-রা, তাহলে তোমাদের প্রত্যেকটি ছেলে আজ ক্ষুদিরাম হত। 


মায়ের সাড়া পায় নাই, মা-রা তাকে কোলে নেয়নি, তাই অভিমানে সে আত্মবলিদান দিয়ে আত্ম-নির্যাতন করে মায়েদের অনাদরের প্রতিশোধ নিয়েছে। যাবার বেলায় দস্যি ছেলে এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলে গেল না। হায় হতভাগা ছেলে! সে কাঁদবে কার জন্যে? যার জন্যে কাঁদবার কেউ নেই, তার চোখের জল যে লজ্জা, তার কাঁদাটাও যে অপমান, মা। দস্যিছেলে সব চোখের জলকে কণ্ঠের নীচে ঠেলে রাখলে। ফাঁসি পরে নীলকণ্ঠ হবার আগেই ব্যথায় নীলকণ্ঠ হয়ে গেল। প্রাণের তিক্ত ক্রন্দনের জ্বালা তার কেউ দেখলে না, দেখলে শুধু কিশোর ঠোঁটের অপূর্ব হাসি। ফাঁসি হ'তে আর দু-চার মিনিট বাকি, তখনও সে তার নিজের ফাঁসির রশির সমালোচনা নিয়ে ব্যস্ত যে, ফাঁসির রজ্জুতে মোম দেওয়া হয় কেন! তোমরা কী ভাবছ মা যে, কী সাংঘাতিক ছেলে বাপু! কিন্তু ছেলে যতই সাংঘাতিক হোক, সত্যি করে বলো দেখি মা, ওই মাতৃহারার তোমাদেরই মুক্তির জন্য ফাঁসিতে যাওয়ার কথা শোনার পরেও কি তোমরা নিজেদের দুলালদেরে বুকে করে শুয়ে থাকতে যন্ত্রণা পাওনা? ওই মাতৃহারার মরা লাশ কি তোমাদের মা ছেলের মধ্যে এসে শুয়ে একটা ব্যবধানের পীড়া দেয় না?


কোথায় ভাই ক্ষুদিরাম? আঠারো মাসের পরে আসবে বলে গেছে, এসেওছো প্রতি ঘরে ঘরে। কিন্তু আঠারো বছর যে কেটে গেল ভাই, সাড়া দাও সাড়া দাও আবার, যেমন যুগে যুগে সাড়া দিয়েছ ওই ফাঁসি-মণ্ডপের রক্ত-মঞ্চে দাঁড়িয়ে। তোমার সাথে আমাদের বারবার দেখাশোনা ওই ফাঁসি-পরা হাসিমুখে!


ক্ষুদিরাম যে স্বাধীনতার অগ্নিমশাল প্রজ্বালন করেছিলেন, শত চেষ্টা করেও ব্রিটিশ সরকার তা নেভাতে পারেনি। এখানেই ক্ষুদিরামের সার্থকতা। তাঁর মৃত্যুর এত বছর পর এসেও যখন হাটে-মাঠে-ঘাটে পথ চলতে প্রায়ই বাউল, সাধক ও কবিয়ালদের কণ্ঠে আচমকা শুনতে পাই, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’, তখন মনে হয়, দেশের জন্য ক্ষুদিরামের এ আত্মদান বৃথা যায়নি। তাঁর মতো ক্ষুদিরামদের কারণেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ একদিন ভারতবর্ষ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। 


আজ এই অগ্নিমানব, মহা বিপ্লবীর প্রয়াণ দিবস। আজকের এই দিনে হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি তাঁকে। ক্ষুদিরামদের বিনাশ নেই, তাঁরা বেঁচে থাকবে হাজার হাজার বছর মানুষের হৃদয়ে…


ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে কৈশরেই শহীদ হন তিনি।ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সর্বকনিষ্ঠ শহীদ বিপ্লবীর নাম শহীদ ক্ষুদিরাম বসু।ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার স্পর্ধার যে শিক্ষা তিনি দিয়ে গেছেন তা স্মরণীয় হয়ে থাক যুবসমাজের কাছে।বাংলা তথা ভারতের ছাত্র-যুবসমাজ প্রকৃত দেশপ্রেমের শিক্ষা নিক শহীদ ক্ষুদিরামদের মত বিপ্লবীদের কাছ থেকে।


দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়ায়,

জাতশেয়াল আর ধর্ষকাম,

তাদের মাঝেও মানুষ হয়ে

বাঁচতে শেখান ক্ষুদিরাম। 


© Luthful Kabir Rony ভাই।




Post a Comment

0 Comments