একটি বিরহের গান

Ads Inside Post

একটি বিরহের গান


golpo-ghar.blogspot.com
golpo-ghar.blogspot.com

ছোট বোনের পড়ার টেবিলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে থাপ্পড় মেরে বললাম, আব্বা তোমরা আমারে হাসপাতাল নিয়া যাও। আম্মা চিৎকার করে বলল, তুমি এখনো বসে আছো কেন? রিক্সা ডাকো তাড়াতাড়ি। আব্বা ছুঁটলেন রিক্সা আনতে। আমি টেবিলের উপরে থাকা একটা খাতার কয়েকটা পৃষ্টা খামচে ধরে দাঁতে কিড়মিড় করে সহ্য করছি। একটু পরই রিক্সা নিয়ে এলেন। আব্বা রিক্সার উপরে বসে আমাকে দুই হাঁটুর চিপায় বসালেন, যেন টলে পড়ে না যাই। বড় রাস্তা অবধি উঠতে উঠতে এলাকার মানুষদের কাছে পঞ্চাশবারেরও বেশি জবাব দিতে হয়েছে আব্বা আম্মাকে। সবার একই প্রশ্ন, শ্রাবণের কী হয়েছে? আব্বা বার বার একই জবাব দিলো, "পোলাটা হঠাৎ পেট ব্যথা কইয়া হাউমাউ কইরা কাইন্দা দিলো।"
আমি জ্ঞান হারাইনি। সদর হাসপাতালের ডাক্তার একটা ইনজেকশন দেয়ার দশ মিনিটের মাথায় আমি সুস্থ। ডাক্তার বলেছে, সকাল থেকে আগের দিনের খাদ্যের অবশিষ্ট পেটে থেকে যাওয়ায়। সকাল বেলাও সে খাদ্য ছোট ঘরে গিয়ে বাহির করিতে না পারার কারণে এই ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে। তবুও মনের সন্দেহ দূর করতে হলে দুই একটা টেষ্ট করাতে পারেন। 
আমি সেদিক অবাক হয়েছিলাম যে, মোট আটটি রিক্সা করে আমাকে হাসপাতালে এলাকার মানুষ দেখতে গেল। সবার একটাই কথা, "এত ভালা পোলাটার হঠাৎ কী হইলো? গতকালও পোলাটা আমার সাথে হাইস্যা কথা কইলো।"
"আমি ভাত খাইতে বসছিলাম, শ্রাবণরে ডাইকা এক লোকমা দিছি, কোনো মান ঘিন নাই পোলাটার। এক লোকমা খাইয়া কয়, চাচি আরেক লোকমা দেও।"
"যেই বয়সে পোলাপাই খারাপ সঙ্গত গিয়া খারাপ হইয়া যায়, সেই বয়সে শ্রাবণডা পোলাপাইনের লগে খেলে। এলাকার পোলাপাইনগুলা দাদা ভাই দাদা ভাই কইরা জান দেয়।"

আমি হাসপাতালের বিছানায় বসে আছি। বাবা বললেন, "আরো দশটা মিনিট দেখি, পরে না হয় বাড়ি যামু। বাবা দেখছস? তোরে দেখতে এলাকার সবাই আইসা পড়ছে। তুই সবার কত্ত আপন হইছোস।"
আমার সেদিকে মন নেই। আমার খেয়াল ব্যথাটা নিয়ে। কতটা অসহ্য ব্যথা হলে টেবিলে থাপ্পড় দিয়ে বলতে পারি আব্বা আমারে হাসপাতাল নিয়া যাও। মানুষের ধৈর্য্য ক্ষমতা অনেক। যখন আর পারে না তখন ভিতর থেকে আওয়াজ বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বলে, "আমি আর পারছি না"।  

ভালোবাসার মানুষটির বিয়ের দুইদিন আগে থেকে মরিচা বাতিগুলো রাতের অন্ধকারেও কেমন জ্বল জ্বল করে হরেক রকমের আলো দিয়ে যাচ্ছিলো। এলাকার মানুষজন ফিসফিস করে কী যেন বলাবলি করছিল। আমি জানতাম তারা আমাকে নিয়েই কথা বলছে। হয়তো কেউ বলছে দেখ, তার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আর সে কেমন দিব্যি হাসিখুশি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বন্ধুরা টিপ্পনি কেটে বলেছিল, দোস্ত হাজার খানেক টাকা দে, দুই তিন লিটার বাংলা মদ নিয়ে আসি। ডগডগ করে গলা দিয়ে নামিয়ে দে আর সবকিছু ভুলে যা। পুরুষ মানুষের মন খারাপ করা মোটেই মানায় না। আমি বন্ধুদের বললাম, শালারা কী ভাবোস আমারে? আমি এতটা দুর্বল মনের না। চল আজ রাতের নয়টা থেকে বারোটা সিনেমার শো দেখে আসি, সব খরচ আমার। বন্ধুরা তো অবাক হবার পাশাপাশি অনেক খুশি হয়ে আমার সাথে সিনেমা দেখতে চলে গেল। ভালোবাসার মানুষের গায়ে হলুদের রাতে আমি সিনেমা দেখায় ব্যস্ত ছিলাম। এক বন্ধু সিনেমা হলে বসে কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে, দোস্ত আমি কিন্তু দেখেছি তুইও আজ হাতে মেহেদি দিয়েছিস। মনে হচ্ছে তোরও আজ বিয়ে। 

বিয়ের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই দুই বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। অচেনা এলাকায় সারাদিন ঘুরে বেরিয়েছি, ছবি তুলেছি। সেই দু'জনকে নিয়ে অচেনা এলাকার সিনেমা হলে আবারো ছবি দেখলাম। বাড়ি ফিরলাম রাত দুইটার দিকে। ঘনিষ্ট বন্ধুটা বলল, আমি তোকে বাড়ি অবধি এগিয়ে দেব। 
আমার বাড়ির সামনেে রাস্তা থেকেই মরিচা বাতিগুলো চলে গিয়েছিল ভালোবাসার মানুষটির বাড়ি পর্যন্ত। আমার সমস্ত কান্নাগুলো বুকের ভিতর দলা পাকিয়ে বসেছিল। ভিতর থেকে বের করতে পারছিলাম না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মরিচা বাতির জ্বলে উঠা আর নিভে যাওয়া দেখছিলাম। আমার ভালোবাসার মানুষটিকে আজ বউ করে অন্য কেউ নিয়ে গেল। আমারো কয়েকটা দিনের জন্য বউ সাজতে ইচ্ছে করছে। ঘোমটা দেয়া বউ। এলাকার মানুষজন দেখবে আমি ঘোমটা দিয়ে আছি। আর ঘোমটার আড়ালে ঝরে পড়বে সেই দলা পাকানো কান্নাগুলো। ঘনিষ্ট বন্ধুটি বলল, দোস্ত তোর ভিতরে খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই না? আমি সেই গভীর রাতে বন্ধুটিকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে দিয়ে বললাম, "দোস্ত আমি আর পারছি না রে।"

রুমি নামের মেয়েটার যেদিন গায়ে হলুদ ছিল, সে সারারাত একটি ঘরে বাতি জ্বালিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিল। রাত পোহালেই চারিদিকে বিয়ের কত আয়োজন। সে নতুন একটি ঠিকানায় যাবে বউ হয়ে। তাকে ঘিরেই এত খুশির আয়োজন। সন্ধ্যা রাতে গায়ে হলুদ ছিল। কত নাচ গান হলো। হলুদ বাটো, মেনদি বাটো আয়োজন হলো। রুমি ছিল পাথরে মূর্তি। না পেরেছে খিলখিল করে হাসতে না পেরেছে ঝর ঝর করে দুই চোখ থেকে বৃষ্টি ঝরাতে। কারণ সে তার বাবা মায়ের একটাই মেয়ে। সবার আনন্দ, সবার খুশি তো সে কেড়ে নিলে পারে না। অথচ রুমির বাবা মা পনেরো দিন থেকে তাকে এক প্রকার পাহাড়া দিচ্ছে। এতদিন রুমির মা এসে রাতে তার সাথে ঘুমিয়েছে। একা ঘুমাতে দেয়নি রুমি'কে। পাহাড়া দেয়ার কারণ দুইটা। এক, রুমি যেন আত্মহত্যার মতো অঘটন ঘটাতে না পারে। দুই, শ্রাবণ নামের অপদার্থের সাথে যেন পালাতে না পারে।
রুমি অঘটনও ঘটায়নি। তার ভালোবাসার মানুষের সাথে পালিয়েও যায়নি। শুধু এক খন্ড পাথর হয়েছে। অনুভূতিহীন পাথর কিংবা বাচ্চাদের খেলনার পুতুল। পুতুলকে সবাই তার ইচ্ছে মতোই নাচাতে পারে। রুমিও না হয় বাকি জীবনের জন্য পুতুল হবে। 

রুমির বাবা মা'সহ বিয়ে বাড়ির অনেকেই সেদিন অবাক হয়েছিল। বিয়ের কনে যেখানে বিদায়ের সময় কান্নাকাটি করে পুরো বাড়ি মাথায় তোলার কথা। কিন্তু আজ রুমির চোখে কোনো পানি নেই। রুমির চোখে আজ চৈত্র মাসের খড়া। সেদিন রুমির চোখে কেউ পানি দেখেনি। সে আজ অন্যের বউ হয়ে নিজ বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। মনটা যেন কোথায় রেখে যাচ্ছে। শুধু দেহটাই, বউ নামক পাথরের মূর্তিটাই যাচ্ছে কথিত শ্বশুর বাড়ি। সবাই কী বউ সাজে? কেউ তো জীবিত লাশ হয়েও শ্বশুর বাড়ি যায়। 

আমাকে আমি পাথর বলি না কখনো। আমি তো এখন এলাকার মধ্যমণি। এলাকার সব বাচ্চারা আমার সাথে রোজ নিয়ম করে খেলতে আসে। আমার নিজেকে বাচ্চা মনে হয় এখন। বন্ধু বান্ধব ছেড়েছি সেই কবে। তারা এসে যখন দেখে আমি বাচ্চাদের সাথে খেলি। তারা বলাবলি করে রুমির বিয়ে হয়ে যাবার পর থেকে শ্রাবণটা পাগল হয়ে গেছে। 
পাশের বাড়ির চাচি আমাকে খেলার মাঠের কাছে এসে ডাকছে। "শ্রাবণ, কই মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মাখাইছি, খেয়ে যা।"
আমি দৌড়ে গিয়ে চাচির হাত থেকে এক লোকমা মুখে নিয়ে আবারো বাচ্চাদের সাথে খেলায় মাতি। 

রুমির ঘনিষ্ট বান্ধবী লিমা সেদিন দাবি করছে কেউ রুমির চোখে পানি না দেখলেও আমি দেখেছি। তবে বেশি না, দুই চার ফোটা। রুমি যখন লাল বেনারশির লম্বা ঘোমটা টেনে কবুল বলে বিয়ের রেজিস্ট্রি খাতায় সাক্ষর করছিল। তার হাত কাঁপছিল। সেখানে সেই রেজিস্ট্রি খাতায় দুই চার ফোটা পানি পড়েছিল। লিমা আরো বলল, রুমির হাতের লেখা কত সুন্দর। অথচ সেদিন সাক্ষর করতে গিয়ে লেখাটা কত বিশ্রী করে লিখব। মনে হচ্ছিল ছল ছল চোখের জন্য নিজের নামটাও ঝাপসা দেখছিল। 
আমি শুনেছি, শুনেও আবার সেই বাচ্চাদের সাথে খেলায় মেতেছি। আমি জানি, রুমির সেই দুই চার ফোটা চোখের জল আমার জন্য। যে আমার জন্য দুই চার ফোটা চোখের পানি রেখে গেছে। তাকে সারাজীবন ভালোবাসতে আর কোনো বাঁধা রইলো না। আমি জানি রুমি সেই দুই চার ফোটা চোখের জল ফেলার সময় মনে মনে বলছিল, "আমি পারলাম না শ্রাবণ, আমি তোর বউ হতে পারিনি রে।"




Post a Comment

0 Comments