golpo-ghar.blogspot.com |
ফেসবুকে একটা গ্রুপে একজনকে ধোলাই চলছে। ব্যাপক ধোলাই। ভেরি ইন্টেন্সিভ মোমেন্ট। এমন সময় বউ এসে জিজ্ঞাসা করল, এখানে বসে আছো কেন?
ফেসবুকের দুনিয়া থেকে চোখ তুলে আসল দুনিয়ায় চোখ রাখলাম। এখানে বসে আছি কেন? বোঝার চেষ্টা করলাম, এটা কী কোনো সাংসারিক প্রশ্ন নাকি দার্শনিক প্রশ্ন। স্ত্রীরা কখন যে গৌতম বুদ্ধ, দালাইলামা হয়ে ওঠে আর কখন রেস্লিং এর জন সিনা হয়ে ওঠে বলা মুশকিল। এটাকে একটা দার্শনিক প্রশ্ন জ্ঞান করে বললাম, কেন যে আছি! আসলে এখানে কিছুই বসে নেই, কেউ বসে নেই। নিহিলিজম। সব শূন্য, ফাঁপা।
পাশের বাসার দিকে ঝাড়ু তুলে দেখিয়ে বলল, ওই বাসায় এক বুড়া আঙ্কেল ঘড় ঝাড়ু দিতেছে আর তুমি এখানে সোফার উপর বসে ফেসবুক নিয়ে পড়ে আছো?
এ পর্যায়ে বুঝলাম প্রশ্নটা আসলে ছিল সাংসারিক। কিন্তু এলোমেলো হয়ে গেলে হবে না। এসময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বললাম, আঙ্কেল বয়স্ক তো, নিজে করোনা ভাইরাসের রিস্কে আছে এজন্য কারো ওপর ভরসা করেনি। নিজেই নেমে পড়েছে। আগে কখনো দেখেছো তাকে ঝাড়ু দিতে?
বলে হাসলাম। অকাট্য যুক্তি। দেখি এবার কী করে খণ্ডায়!
বউ ঠোঁট বাঁকিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, এই তোমার বুদ্ধি!
আমার বুদ্ধি নিয়ে আজতক কেউ কোন প্রশ্ন করেনি, আমিও কোনো গোলমাল কখনো করিনি। তবু বাসাতে প্রায়ই শুনতে হয়, এই তোমার বুদ্ধি! আমি প্রশ্নবোধক একটি দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে বললাম, কী?
স্ত্রী গজগজ করতে করতে বলল, কোনো বাসায় কোনো বুয়া নেই তাই বাসার কাজে সবাই হেল্প করছে। হি ইজ এ নাইস পারসন। ভেরি আন্ডারস্টান্ডিং, এন্ড এম্পেথেটিক।
কী আশ্চর্য! আমি এই জীবনে কোনোদিন বাসা ঝাড়ু দেইনি। কই আমাকে ত কেউ কখনো বলেনি আমি নাইস পার্সন না! তবে যুক্তিতে ধরা খেয়ে যাচ্ছি। এলোমেলো হয়ে গেলে চলবে না, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। গেমটা চেঞ্জ করে দেই। বললাম, আচ্ছা আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। দাও আমি ঝাড়ু দিয়ে দিচ্ছি।
স্ত্রী আবার আমার দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকাল, বলল, আমি তোমাকে ঝাড়ু দিতে বলেছি?
আশ্চর্য। তাহলে এত কথার মানে কী? চকিতে আমি বুঝে গেলাম। অবস্থা আমি যতটা নরমাল ভেবেছিলাম ততটা নরমাল নয়। ঝাড়ু, বুড়া এগুলো কিছু নয়, এগুলো হলো দাবার গুটি, পেছনে আরো হাতি, ঘোড়া, মন্ত্রী ওঁত পেতে আছে। এতক্ষন আমি সিচুয়েশনের গ্রাভিটিই বুঝিনি। বড় বিপদ আসছে, এগুলো তার আলামত। তবে এলোমেলো হয়ে গেলে চলবে না, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে কী?
সে বলল, চায়ের কাপটা এখানে কেন?
আমি টেবিলের উপর তাকালাম। মনে হছে টেবিল থেকে কাপটাও আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, বলছে, কি অবস্থা ব্রো! খুব ক্যালানির ওপরে আছো?
চায়ের কাপটা এখানে কেন? এই প্রশ্নের জবাবেও নিহিলিজম ছাড়া আর কিছুই তো মাথায় আসছে না। চায়ের কাপটা এখানে কেন? এ প্রশ্নের কী জবাব হতে পারে? নাহ, জটিল চিন্তা করা যাবে না, সহজ চিন্তা করতে হবে। একেবারে সরল। কোন দর্শনে যাওয়া যাবে না। দর্শন খুবই উচ্চ মার্গীয় ব্যপার, এরা বুঝবে না।
বললাম, চা খেয়েছি এখানে বসে তাই কাপ এই টেবিলের উপর।
স্ত্রী এবার অনেকটা কড়া সুরে জিজ্ঞাসা করল, সেটা আমি জানি না? তুমি এখানে বসে চা খেয়েছ বলেই তো কাপটা এখানে, এখানে চা খাবে আর কাপ গিয়ে মঙ্গল গ্রহে পড়ে থাকবে, তা তো না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাপটা কি এখানে থাকার কথা?
আমি দুহাত দিয়ে মাথা চুলকালাম। এটাতো নিহিলিজমে বাপ! কাপটা এখানে থাকার কথা ঠিক আছে কিন্তু কাপটা এখানে কেন? এ প্রশ্নের জবাব আমি কী দেব? স্ত্রী কি সামহাউ ‘ইনসেপশন’ বা ‘প্রিডেস্টিনেশন’ সিনেমা দেখে এসেছে?
আমি ভয়ার্ত চোখে একবার তার দিকে তাকালাম। কিন্তু এলোমেলো হয়ে গেলে চলবে না, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বললাম, তুমি কী বলছ আমি বুঝেই উঠতে পারছি না।
স্ত্রী এবার হতাশ হয়ে আমার আরেকটি সোফায় বসে পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি একটু কনসিডারেট হতে পারো না?
আমি প্রমাদ গুনলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। চায়ের কাপ থেকে আমার ব্যপারে এসে পড়েছে। কিছু বললাম না। তাকিয়ে থাকলাম। এসময় এলোমেলো হয়ে গেলে চলবে না, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।
স্ত্রী বলল, এক ঘন্টা আগে চা খেয়েছ, এই কাপটা কি সিংকে রেখে আসা যেত না?
ওহ এই কথা! এখনি রেখে আসছি, এ আর এমন কী? আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখনই রেখে আসছি।
স্ত্রী বলল, এখন রেখে আসতে হবে না। তোমার সাথে আমার কথা আছে!
‘তোমার সাথে আমার কথা আছে!?” এর চেয়ে বিপদজনক ডায়ালগ বিবাহিত পুরুষের জীবনে আর হয় না। কি করা যায়! কি করা যায়!! কিছুক্ষণ ভেবে দেখলাম আসলে কিছু করার নেই।
হাসিমুখে বললাম, বলো!
বলল, তুমি ঠিক করে বলো তুমি কবে ঠিক হবে?
মানে কী? আমি কী বেঠিক? খুবই অপমানজনক কথা। তবে রেগে গেলে এলোমেলো হয়ে যেতে পারি। এলোমেলো হওয়া যাব না, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।
আমি বললাম, আমি বেঠিকের কী করলাম? আমি তো ঠিকই আছি।
ঠিক আছো?
হ্যাঁ
সকাল থেকে কী কী করেছো?
সকাল থেকে কী করেছি সেটার সাথে আমার বেঠিক হবার কী সম্পর্ক বুঝলাম না। আমি কিছু বলার আগেই সে বলল, এগারোটায় ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করে নাস্তা খেয়েছো তারপর থেকে এখন একটা বাজে, সোফায় বসে বসে ফেসবুকিং করেছ। আর আমি কী কী করেছি?
ধুর শালা! সহজ প্রশ্নটার উত্তর সে দিয়ে আমাকে কঠিন প্রশ্ন ধরলো! মাথাটা একটু এলোমেলো এলোমেলো লাগছে। কী করা যায়!
বললাম, তুমি কাজ করেছো! নাস্তা বানিয়েছ, চা বানিয়েছ...
বেশি বলতে পারলাম না, সে ইন্টারফেয়ার করল, বলল, নাস্তা আমি বানাইনি এটাও তুমি জানো না। খালা নাস্তা পাঠিয়েছে তোমার জন্য। তাকে একটু ফোন করে থ্যাঙ্কস তো দিলেই না, উলটা তোমার মনেও নেই।
কোন খালার কথা বলছে? আমার খালা শাশুড়িও আছে, জানতাম না তো! এরপর থেকে লিস্ট করে লিখে রাখতে হবে। নাহ, আরো বেশি এলোমেলো লাগছে। এখন কথা না বলাই ভালো হবে। যদি প্রশ্ন করে বসে, খালা শাশুড়িকে চিনেছ? তখন? আমি আর ভাবতেই পারলাম না। শেষ অস্ত্র হিসাবে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা। স্ত্রী নরম সুরে বলল, যাই হোক, সংসারের কোন কাজ তোমার করতে হবে না। আমি সারাদিন অনেক স্ট্রেস এ ছিলাম। এখন আমার সাথে একটু কথা বলো!
এই জীবনে আমি অনেক বক্তৃতা দিয়েছি, তুমুল আড্ডায় কথার তুবড়ি ছুটিয়েছি, ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লাস, ট্রেইনিং ইত্যাদি নিয়েছি। কিন্তু যখন একজন স্ত্রী তার স্বামীকে বলে, আমার সাথে একটু কথা বলো, তখন, আমার বিশ্বাস, পৃথিবীর যেকোন স্বামীর মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। সে হঠাৎ বুঝতে পারে সে আসলে আজম্ম বোবা। তার কোনো ভাষাজ্ঞান নাই। আমার ক্ষেত্রেও সেটা হলো, তবে এলোমেলো হওয়া যাবে না। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।
আমি হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আছেন কেমন? শরীর ভালো? আপনার পিতা-মাতা কেমন আছে? ভালো?
আমাকে অগ্নিচোখে ভস্ম করে দিয়ে স্ত্রী বলল, তুমি ফাইজলামো করতেছো আমার সাথে??
আমি আর কথা বলতে পারলাম না। কী ভুল করলাম তাও বুঝলাম না। আসন্ন ভবিষ্যতে কী হতে পারে কি জানি! দুচোখ বন্ধ করে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। এলোমেলো হয়ে যাওয়া যাবে না, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।
(রম্যগল্প)
0 Comments
Thanks for your valuable comment. We will be back soon.
Thank you 😊😊😊